ফেইসবুকপ্রজন্মের ভাবনায় বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের গোড়া ‘শাহবাগ গণজমায়েত’

প্রথম প্রকাশ ফেইসবুক, ০৫ মে ২০২১

সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানাতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক নিজেকে ‘শাহবাগী’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে শাহবাগ আন্দোলনের কারণে। তিনি লিখেন; ‘২০১৩ সালে যে শাহবাগ আন্দোলন হয়, ৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে বেলা পৌনে চারটায় আমি শাহবাগে উপস্থিত হই। তখন মাত্র ৩০/৪০ জন শাহবাগে উপস্থিত হয়েছিল। একটু খোঁজ-খবর করলেই জানা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে শাহবাগ আন্দোলনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। নানান ঘটনা পেরিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের ফসল আওয়ামী লীগ ঘরে তোলে, তারা আবার ক্ষমতায় আসে। আজ যখন শহিদ মিনারে ছাত্রলীগের সদস্যরা আমাদের জামাত-শিবিরের দোসর বলছিল মাইকে, তখন তীব্র হাসি পাচ্ছিলো।”(১)

সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসান লিখেন; ”আওয়ামী লীগ এবং তার রাজনীতি ব্যবসার পেশীজীবীদের মুখে সাধারণ মানুষকে জামাত-শিবির-রাজাকার বলে গালি দেয়া আসলে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ নেতা জর্জ ডব্লিউ বুশের মুখে, “ইউ আর আইদার উইথ আস অর এগেইন্সট আস”–এর আওয়ামীলীগিয় অনুবাদ হচ্ছে, ‘আপনি হয় আওয়ামী লীগ অথবা জামাত-শিবির-রাজাকার।'(২)

বামধারার অধ্যাপক ফাহমিদুল হক এবং সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসান নিশ্চয়ই রক্ষণশীল বা ধর্মবাদী ধারার কোন পার্টির লোক নন। যেই ভাষায় তাঁরা বর্তমান শাসনকে চিত্রায়িত করেছেন একই ভাষা যদি আরো তিন চার বছর আগে কেউ ব্যবহার করত তাঁদেরকে জামায়াতী বা ইসলামপন্থী হিসেবে ট্যাগ দিতে দেখা যেত। যারা সেসব ট্যাগ দিতেন তাঁদের অনেকেই আজকে একই ট্যাগে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের এই কি বিচার? বিস্তারিতভাবে এর কারণ ও গোড়া অনুসন্ধান করা জরুরী। সেই লক্ষ্যেই এই পোস্ট।

সম্প্রসারণশীল ধর্মভাবাপন্ন এক্টিভিস্ট মোকাররম হোসাইন বর্তমানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের গোড়া চিহ্নিত করতে গিয়ে ২০১৬ সালের এক মন্তব্যে দায়ী করেছেন শাহবাগ জমায়েতকে। তিনি লিখেন; ”শাহবাগ লিগেসি হিসেবে উত্থান হয়েছে একটি গণতন্ত্রবিনাশী অতিকায় স্বৈরতন্ত্রের। আর এই স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক শাহাবাগ আন্দোলন প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক, মানবিক অধিকার অস্বীকারের মাধ্যমে মতপ্রকাশের ও সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ ধ্বংস করেছে সম্পূর্ণভাবে। তারা নিজেরাই এখন সেই ব্যবস্থার ভিকটিম।” (৩) এই পর্যবেক্ষণ প্রতিধ্বনিত হয়েছে শাহবাগ জমায়েতে সক্রিয় সমর্থনদানকারী উদারনৈতিক বামধারার এক্টিভিস্ট ও লেখক সহুল আহমেদ মুন্না’র সাম্প্রতিক মন্তব্যে। তিনি লিখেন;

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ চলাকালীন সময়ে অনেকেই এর কিছু কিছু সমালোচনা করেছিলেন, কিংবা কোন কোন বিষয়ে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছিলেন। সমালোচনা করা মানে কেউ শত্রু হয়ে গেলো এই ভাবনার মধ্যে আর যাই হোক কোন ‘চিন্তা’ নাই। জামায়াত-শিবিরও ভারতের সমালোচনা করে, আবার বামপন্থী/লীগের চিন্তাশীলের একাংশও ভারতের আধিপত্যবাদের সমালোচনা করেন; দুটোই ভারতের সমালোচনা কিন্তু দুইটাকে আপনি এক কাতারে ফেলতে পারবেন না। জামায়াত-শিবির যখন সমালোচনা করে তখন স্পষ্টত ‘সাম্প্রদায়িকতা’র গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। সব সমালোচনাকে এক করে দেখার প্রবণতা ভয়ঙ্কর, এবং এই কাজটাই ২০১৩তে ঘটেছিল। মঞ্চের সাথে যখনই কেউ দ্বিমত পোষণ করছিলেন, আমরা তার মত বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে খারিজ করতে পারতাম, (কখনো কখনো করাও হয়েছে) কিন্তু, আমরা তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে ‘নব্য রাজাকার’ বা ‘পাকিস্তানপন্থী’ ট্যাগ দিয়েছি। এই সময়ে আওয়ামীলীগ সরকার যেভাবে যারে তারে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ ট্যাগ দিচ্ছে তার প্রচলন শুরু হয়েছিল আমাদের হাতেই, মানে মঞ্চের হাতে।…মঞ্চের প্রচুর ইতিবাচক প্রভাব যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও আছে। বর্তমানে আওয়ামীলীগ সরকারের যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তার অনেককিছুর গোড়া মঞ্চেই। এই দায় মঞ্চের নিতে হবে, যেমন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জন্যে মানুষকে একত্র করে রাস্তায় নেমে পড়ার কৃতিত্বটাও মঞ্চকে দিতে হবে।”(৪)

বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা শফিউর রহমানের মন্তব্য আরো সুনির্দিষ্ট। তিনি লিখেন, ”সরি কমরেডস! বাংলাদেশকে কানাগলিতে নিয়ে যাওয়ার পিছনে শাহবাগ আন্দোলনের বিশাল অবদান আছে। ফলে শাহবাগীরা যখন গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে বিলাপ করে তখন আমার সন্দেহ হয়।”(৪) ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার কোন রাষ্ট্রেই হঠাৎ করে হাজির হয় না। ধীরে ধীরে সমাজ থেকে তাঁর হাজির হবার শর্ত এবং টিকে থাকার বৈধতা নির্মাণ করে। মোকাররম হোসাইন তাঁর সাম্প্রতিক অন্য আরেকটি মন্তব্যে আবারো শাহবাগ মঞ্চের ভূমিকাকেই বর্তমানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য দায়ী করে লিখেন; ”স্বৈরাচারি রেজিম একদিনে এই জায়গায় আসেনি। এবং তার চুড়ান্ত রূপ দেখতে আরো বছর কয়েক অপেক্ষা করতে হবে। যেকোনো স্বৈরাচারি রেজিমকে টিকে থাকতে তার প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে হয়। একক শক্তি হিসেবে প্রবল ক্ষমতার প্রদর্শনি সহ হাজির থাকতে হয়। আর শাহবাগ আন্দোলন এই স্বৈরাচারি রেজিমের উত্থানে প্রধান প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।”(৫)

উপরোক্ত মন্তব্যগুলোতে দৃশ্যমান, সমসাময়িক পরিস্থিতি ও নিপীড়নবাদী শাসনের গোড়া হিসেবে শাহবাগ আন্দোলনকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে ডান-বাম ও মধ্যপন্থী ধারার একটিভিস্টদের মধ্যে একধরনের ঐক্যমত তৈরি হচ্ছে। যত দ্রুত মতামত তৈরি করতে সক্ষম সংখ্যাগুরু এক্টিভিস্টদের মধ্যে এই ধরনের ঐক্যমত তৈরি হবে, ততদ্রুত বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে এক্টিভিস্ট মোকাররম হোসাইন মনে করেন, ”যে শাহবাগ আন্দোলন রেজিমের উথথানে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তাদেরকেই রেজিমের বিরোদ্ধে দাঁড়াতে হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠন আন্দোলন করতে হবে। রেজিমের অপসারণ যেমন জরুরি রাষ্ট্রের পুনর্গঠন আরো বেশি জরুরি।”(৬)

তালাশের সূত্রঃ

(১) Fahmidul Haq, ফেইসবুক পোস্ট, ১৫ জুলাই ২০১৮, https://www.facebook.com/fahmidulhaq/posts/10155377461331556

(২) মাসকাওয়াথ আহসান, ‘আপনি হয় আওয়ামী লীগ অথবা জামাত-শিবির-রাজাকার’, ১৩ জুলাই ২০১৮, https://www.facebook.com/maskwaith/posts/10215963524897362

(৩) Mokarrom Hossain, ফেইসবুক পোস্ট, ০৭ মে ২০১৬, https://www.facebook.com/mokarromhssn/posts/10207371937029644

(৪) সহুল আহমেদ মুন্না, ফেইসবুক পোস্ট, ১০ জুলাই ২০১৮, https://www.facebook.com/sohulahmed.munna/posts/1963635556994179

(৪) শফিউর রহমান, ফেইসবুক পোস্ট, ১৬ জুলাই ২০১৮, https://www.facebook.com/shafiur.rahman.58/posts/1635422336566413

(৫) Mokarrom Hossain, ফেইসবুক পোস্ট, ৪ জুলাই ২০১৮, https://www.facebook.com/mokarromhssn/posts/10213491242168448

(৬) প্রাগুক্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *