১৯৪৭ উত্তর ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রসেস
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে, ক্ষমতার হস্তান্তর কিভাবে হয় এসব বিষয় সাধারনের ধারণা খুব কমই। অধিকাংশ মানুষ ওতটুকুই দেখে যতটুকু ক্ষমতার মূল কারিগরেরা দেখাতে চান। ১৯৪৭ সালের আজাদীর পর আমাদের অঞ্চলে যত দল বা গ্রুপ ক্ষমতায় এসেছে তাঁদের অবস্থান সমাজের উপরিতলায়, যাকে আমরা বলি পলিটিক্যাল ক্লাস (রাজনৈতিক শ্রেণী)।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৪ সালে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে জয়ী হলেও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। পাকিস্তানের পলিটিক্যাল এলিটদের কাছে পূর্ববংগের চাষাভুষাদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া সহজ ছিল না। এই ধারবাহিকতা পুরো পাকিস্তান পিরিয়ডে ছিল। এমনকি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলাফলও যে পাকিস্তানের এলিটদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা বেখেয়াল। আমাদের অনেকেই বীরত্বের কাহিনী নিয়ে মহাকাব্য লিখে ফেলেছে। অবশ্যই আমাদের বীরত্ব ছিল। কিন্তু কয়জন জানেন যে, ১৯৭১ সালের নভেম্বরেই পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান রহিম খান ও চিফ অফ আর্মি স্টাফ গুল হাসান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো মিলে সীদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার। ডিসেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করে সবগুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নেয় তাঁরা। আর এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ভারতে আক্রমণ করা হয়, যাতে করে প্রসেসটা দ্রুত হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক অফিসার, পাকিস্তানী ডিপ্লোমেট এবং আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও ভূট্টো-এই তিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সহকারী আরশাদ সামী খানের লেখা ‘Three presidents and an aide: life, power and politics’ বইয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত বয়ান রয়েছে।(১)
যাইহোক, কথা হচ্ছিল ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে এবং ক্ষমতার হস্তান্তর কিভাবে হয় নিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের অভুত্থানের পরিবেশ তৈরিতে তাঁদের ভূমিকা থাকলেও, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতা চলে যায় আমাদের সিভিল-মিলিটারি ব্যরোক্রেসির (পলিটক্যাল ক্লাস) হাতে। তাঁরাই পরবর্তী ১৫ বছর রাষ্ট্র চালায়। এই সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন(পলিটক্যাল শ্রেণী) এর হাতে বিএনপি ও জাতীয়পার্টি নামে দুটি দল দাঁড়িয়েছে, যাঁদের আগমনও সমাজের উপরিতলা থেকে। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা পর্যায়ক্রমে ঘুরেছে এই ৪ গ্রুপের হাতে- আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং আর্মি-তাঁরাই আমাদের পলিটক্যাল ক্লাস। এই শ্রেণী দেশে যে পলিটিক্যাল স্যাটেলমেন্ট দাঁড় করিয়েছে সংক্ষেপে সেটার কাঠামো হলঃ রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-ব্যুরোক্রেট-মাস্তান। আর এই কাঠামোর পক্ষে সম্মতির উৎপাদন (consent manufacture) করে চলেছে সিভিল সোসাইটি এবং মিডিয়া। এই কাঠামো নিয়ে গত কয়েকদিন লিখেছি।(২)
ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকালেও প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। প্রতিষ্ঠিত পলিটিক্যাল ক্লাসের বাহিরে ক্ষমতার প্রশ্নে বিচ্যুতি (ডাইভারজেন্ট) খুব কমই। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ সেখান থেকে চলে এলে বিরোধী দলের জায়গা পূরণ করে কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির হাতে নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাঁদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসেন মমতা দিদি। কোথা থেকে আসলেন তিনি? কোন যদু মধু নিয়ে তিনি দল গড়েন নি। তিনি ক্ষমতাসীন ‘জাতীয় কংগ্রেস’ থেকে বেরিয়ে এসে বানালেন ‘তৃণমূল কংগ্রেস’।
সাম্প্রতিক সময়ে এসে ব্যতিক্রম দেখা গেল দিল্লিতে ‘আম আদমি পার্টি’ এবং পাকিস্তানে ‘তেহরিকে ইনসাফ’। ইমরান খানের নেতৃত্বে ‘তেহরিকে ইনসাফ’ ক্ষমতায় আসতে ২২ বছর লড়াই করতে হয়েছে। তাও শোনা যায় পাকিস্তান আর্মির প্রচ্ছন্ন সাপোর্ট তিনি পেয়েছেন। সে নিজেও এলিট শ্রেণী থেকে আগত। আম আদমির কেজরিওয়ালও সাবেক ব্যুরোক্র্যাট। অর্থাৎ, আমার পয়েন্ট হল, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত পলিটক্যাল ক্লাসের বাহিরে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ আমাদের জমিনে নেই, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও খুব কম।
বর্তমান বাংলাদেশে আমরা একটা নতুন ধরনের স্বৈরাচারী শাসন দেখছি।পাকিস্তান আমল থেকে এরশাদ পর্যন্ত পূর্বের সকল স্বৈরাচার ছিল সামরিক। তাঁদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সকল গ্রুপের মধ্যে বিভিন্ন ফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমান স্বৈরাচারের পোষাক খাকি নয়, তারা মিলিটারিও নয়, তাঁরা সাদা পোষাকের এবং তাঁদের রয়েছে দীর্ঘ গণতন্ত্রের লড়াইয়ের ইতিহাস। এই স্বৈরাচারের পতন কিভাবে হবে? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়েই উপরের আলোচনাটুকু মাথায় আসল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, গত একাধিক নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ দূরে থাক, সরকারী দলের লোকেরাই অংশগ্রহণ করেনি। তাহলে কিভাবে টিকে আছে এই সরকার? খুব সহজ হিসেবঃ জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগ-ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র-মাস্তান কাঠামোর মাধ্যমেই টিকে আছে সরকার। আর তাঁদের নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে সিভিল সোসাইটি।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, স্বৈরাচারের পতন তখনই হয় যখন প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়। এই টানাপড়েন ঘটে কেবল মাত্র মাঠ উত্তপ্ত হলে। আইয়ুব খানের শেষের দিকে যখন মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠল, দেশের উপর যখন সরকারী শাসন অকার্যকর হয়ে উঠল তখন জুলফিকার আলী ভূট্টো আইয়ুবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ক্যু ঘটায়। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া। তাঁকেও একই কায়দায় যেতে হয়েছিল। আমাদের এখানে এরশাদের শেষ সময়ে যখন মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠল, এরশাদ আর্মি প্রধানকে ফোন দিয়েছিলেন তাঁকে সাহায্য করতে। আর্মি থেকে বলা হল-sorry, your times up. বলা হয়ে থাকে আর্মি প্রধান তখন এরশাদের ফোনও ধরেন নি। মাঠ উত্তপ্ত হলে পলিটিক্যাল এলিটদের মধ্যে নতুন বোঝাপড়া তৈরি হয়, তাঁরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার্থেই কাঠামোর পূনর্বিন্যাস ঘটায়। প্রসব বেদনা না উঠলে যেমন বাচ্চা ডেলিভারি হয় না, ঠিক তেমনি মাঠ উত্তপ্ত না হলে স্বৈরাচার পতনের প্রশ্নই আসে না। এই কাঠামোর বাহিরে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র রাস্তা হল বিপ্লব।
বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত ও কালচারাল রাজনীতির অনুসারীরা (যেমনঃ ইসলামপন্থা এবং বামপন্থা)ক্ষমতার নিয়ামক ছিল না কখনই। তাঁরা ক্ষমতায় যেতে না পারলেও, বিপ্লবের নামে মানুষজনের মধ্যে ভুল সচেতনতা (erroneous consciousness), মিথ্যা আশ্বাস (false hope)তৈরি করে রাজনৈতিকভাবে নির্জিব করে রাখতে সফল। তাঁরা মনে করে, পুতপুত বুদ্ধিজীবিতা এবং ধর্মীয় জজবা দিয়ে তাঁরা একদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে যাবে। আমি কালচারাল সচেতনতা ও সামাজিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে তাঁদের ইউটিলিটি স্বীকার করলেও, নির্ধিদায় একথা বলতে পারি, রাষ্ট্রের বাস্তব সংকট নিয়ে তাঁরা কখনো ভাবিত নয়। রাষ্ট্র কিভাবে কাজ করে সেই বোধ, কমনসেন্স ও বোঝাপড়া থেকে তাঁরা কাল্পনিক জগতে বসবাস করতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এ কারনে এই শ্রেণী থেকে নেতৃত্ব উঠে এসে স্বৈরাচারের পতন ঘটানোর ব্যাপারে আমি এখনো আশাবাদী নই, বরং অনেকাংশে যথেষ্ঠ সন্দিহান।
নোক্তাঃ
(১) ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইয়াহিয়া পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান রহিম খান ও চিফ অফ আর্মি স্টাফ গুল হাসান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চীনে পাঠিয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য। চীনা নেতারা পাকিস্তানের অবনতিশীল পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তখনই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে না জড়ানোর পরামর্শ দেন। তাঁরা এ-ও বলেন যে যদি যুদ্ধে যেতেই হয়, পাকিস্তান যেন পরবর্তী গ্রীষ্ম মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কেননা, শীতের মৌসুমে হিমালয়ের পাদদেশ বরফাচ্ছাদিত থাকার কারণে চীনের পক্ষে সিকিম সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। সেখানেই ‘ত্রয়ী’ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছেন। ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার চিফ অব স্টাফ গুল হাসান বুঝে গেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আর রক্ষা করা যাবে না। যুদ্ধে পরাজয় ছাড়া ইয়াহিয়াকে সরানো কঠিন। তাই তাঁরা সহজ পথ নিলেন চীন সামরিক সমর্থন না দিলেও ডিসেম্বরেই যুদ্ধের সমাপ্তি টানা। গুল তাঁর সামরিক বিশ্লেষণে উপসংহার টেনে বলেন, শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হবেই। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এভাবে বিচ্ছিন্ন হলে সামরিক বাহিনীর সর্বস্তরে বিদ্রোহ দেখা দেবে এবং তারা কাউকে ছাড় দেবে না। গুল হাসানের দাবি, ‘আমরা যদি আমাদের কার্ড ঠিকমতো খেলতে পারি, তাহলে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে। যখন পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটবে, আমাদের কর্তব্য হবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার অনুকূলে যেকোনো উপায়ে ইয়াহিয়াকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করানো। তাতে অন্তত যাঁরা ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের সঙ্গে তেমন যুক্ত নন, তাঁরা রক্ষা পাবেন। যখন পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে, তখন আমাদের ভুট্টোকে ক্ষমতায় বসানোর পরামর্শ দিতে হবে।’ ( বিস্তারিত দেখুনঃ সামি খানের বইয়ের আলোকে সাংবাদিক ‘সোহরাব হাসান’ কর্তৃক লিখিত, ‘পথের কাঁটা সরিয়ে দিলেন ভুট্টো’, প্রথম আলো, ০৬ মার্চ ২০১৭ এবং ‘ইয়াহিয়াকে সরানোর ষড়যন্ত্র হয় নভেম্বরেই’, প্রথম আলো, ০৭ মার্চ ২০১৭)
(২) বাংলাদেশে বিদ্যমান পলিটিক্যাল সেটেলম্যান্ট, ক্লায়েন্টিজম এবং রাজনীতিকদের চরিত্র, https://www.facebook.com/nazmul1985/posts/10225684093107750