অনলাইনে বিভিন্ন মতবাদের অনুসারীদের মধ্যকার বিতন্ডাগুলো আমাদের জাতীয় সংকটেরই প্রতিফলন। আমি এসবে অভ্যস্তও। কিন্তু আমার আগ্রহের জায়গা এখান থেকে উত্তরণ নিয়ে। কিভাবে সামনে অগ্রসর (মুভিং ফরোয়ার্ড) হব আমরা? আমার মতে, রাস্তা হল thinking principle, not ideologically.
আমি দেখেছি, কোন সমস্যায় নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বললে লোকজন ‘সুশীল’ বলে। কারন এই অবস্থান হয়ত সরাসরি কোন দলকে বা গ্রুপের পক্ষে যায় না বা পুরোপুরি যায় না।নীতির ভিত্তিতে আলোচনায় আমি জনগোষ্ঠীর সবার (ডান-বাম-আস্তিক-নাস্তিক-নারী-পুরুষ) সাথে কথা বলতে পারি, যেটা মতাদর্শতাড়িত হয়ে সম্ভব নয়। মতবাদ বা আইডিওলজি চরিত্রগতভাবেই এক্সক্লুসিভ। যারা অতিমাত্রায় মতবাদতাড়িত (আইডিওলজিকালি বায়াস) তাদের পক্ষে সঠিক জাজমেন্ট করাও একপ্রকার অসম্ভব। অসম্ভব ইনক্লুসিভ চিন্তা করা। কেননা আইডিওলজি চরিত্রগতভাবেই আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং আত্মপরিচয়ের হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
যারা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত বা যারা কোন দলের সমর্থক বা যারা কোন মতবাদের অনুসারী তাদের নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু তাদের নিজেদের সীমানা ও সীমাবদ্ধতা বুঝা জরুরী।
অনলাইন, বিশেষকরে ফেইসবুক হচ্ছে আমাদের গ্রামের চা-দোকানের ডিজিটাল ভার্সন। সেখানে প্রতিনিয়ত হাতি-ঘোড়া মারা হয়, হাসিনা-খালেদার প্রচুর উপদেষ্টা সেখানে পাওয়া যায়। অনলাইনে বিভিন্ন মতবাদ ও মতাদর্শের মানুষজন থাকার সুবিধা হল সমাজের যাবতীয় ধারা-উপধারার টেনশন, মতামত, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো আমরা দেখতে পাই। সমস্যা তৈরি হয় যখন পলিটিক্যালি বা আইডিওলজিকালি টেনসড ইস্যুতে বিভিন্ন দল ও মতবাদের অনুসারীরা দলীয় ও মতাদর্শিক লাইনে my way or high way দেখানো শুরু করেন। অনলাইনের এই বিকল্প জনপরিসরে আধিপত্য বিস্তারের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। এজ ইফ, ফেইসবুকে আজই সরকার পতন ঘটে যাচ্ছে, সেজন্য সবাইকে এক পক্ষে ঝাঁপিয়ে পরতে হবে। আমার কাছে এসব অলিক কল্পনা ও অনুমান মনে হয়। সরকারের পরিবর্তনের আন্দোলন হতেই পারে,তবে সেটা নির্ধারিত হবে রাস্তায়, অনলাইনে না। কোন সুপারম্যানের জ্বালাময়ী ভাষনে একরাতে এখানে বিপ্লব হয়ে যাবে না, কারো দল বা মতাদর্শ পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এই বোধধয়টা আমাদের জরুরী।
অভিজ্ঞতার আলোকে আমার প্রচেষ্টা হল নীতিগত (Principle) অবস্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করা ও মতামত গঠন করা। দুঃখজনকভাবে, আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ দলীয় লোকেরা দলের সদস্য হবার সাথে সাথে নিজেদের আত্মাকে বন্দক দিয়ে দেন। ফলে, দলের যে পজিশন বা দলের নেতা ও নেত্রির যে পজিশন (সেটা নৈতিক ও নীতিগতভাবে সঠিক বা বেঠিক হোক) সেটার পক্ষে যুক্তি তুর্ক ও রেফারেন্স দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের আপাত কাজ। বাংলাদেশের ক্লায়েন্টিস্ট পলিটিক্যাল কাঠামোতে এবং আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে এই ধরনের নতজানু অবস্থান বোধগম্য। কিন্তু যারা দলান্ধ বা মতান্ধ নন, তাদের জন্য বেস্ট অপশন হল নীতিগত অবস্থান।
নীতিগতভাবে, পুলিশের গুলিতে নিহতদের পক্ষে আমার অবস্থান। কারন, সকল যুক্তি তর্ক চাপিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে তারা মজলুম। রাষ্ট্র এখানে জালেম। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায়, রাষ্ট্রের ভায়োলেন্স করার যে অভূতপূর্ব ক্ষমতা এবং সেটাকে জাস্টিফাই করার যে রিসোর্স (ইনক্লুডিং মিডিয়া) সেটা কোন নাগরিকের নেই, কোন সংগঠিত দলেরও নেই, যদি না তারা স্বীকৃত বিপ্লবী বা সন্ত্রাসী গ্রুপ হয়। রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে প্রতিবাদকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পরেছিল। রাষ্ট্র এখনো তাই-ই করছে। রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক দর্শন হলঃ সিকিউরিটি এবং আইনশৃঙ্খলা (Law and Order)। এ কারনে ২১ জন নাগরিক খুন হয়েছে এটার বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কনসার্ন না, যতটা কনসার্ন সরকারী অফিস ভাংচুরের শিকার হওয়া।
নীতিগতভাবে যদি আমরা ভাবি তাহলে দেখব, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার একমাত্র বৈধতা (সোস্যাল কন্ট্রাক) হল নাগরিকের সুরক্ষা। কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের একটা ঐতিহাসিক রায় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যার সারমর্ম হল- ‘নাগরিকের অধিকার ক্ষমতাসীন কোনো শাসকের মর্জির উপর নির্ভরশীল নয়’। অনেকের কাছে মনে হতে পারে এসব ঠু মাস টু থিংক অফ। অবশ্যই। কারন যে রাষ্ট্রে গুম, খুন, ক্রসফায়ার, ব্যক্তিগত গোপীয়নতার লঙ্গন নিত্যদিনের কাহিনী, সেখানে এসব অতিকথন মনে হতেই পারে। কিন্তু আমাদেরকে নীতিগত জায়গা থেকে বিবেচনা করলে উচ্চ নৈতিক অবস্থান থেকে আরো উচ্চতর লক্ষ্য ও নাগরিক কল্যাণরাষ্ট্রেরই স্বপ্ন দেখতে হবে। যারা মতাদর্শতাড়িত তাদের পক্ষে নীতিগত (Principle) অবস্থান নেয়া সম্ভব নয়, কারন আইডিওলজি মানেই হল my way or highway.
আমার কাছে বর্তমান ক্রাইসিসে হেফাজতের পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান দুটোকেই আইডিওলজিকাল মনে হয়। দুই পক্ষের যুক্তিই আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। দুইটি ভিন্ন মতবাদ-মতাদর্শের মধ্যে কখনোই ঐক্য সম্ভব নয়, সেই চেষ্টা করাও বৃথা। ভিন্নমতের মানুষের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেবল নীতিগতভাবে (Principle).
হেফাজত আমার অধিকার সংকোচিত করবে এরকম ‘অনুমান’ থেকে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জুলুম ও গুলিকে বৈধতা দেয়া নৈতিক দেউলিয়াত্বের লক্ষণ। কেননা, যা ঘটেনি (হেফাজত ক্ষমতায় কখনো আসেনি) সেটাকে ‘কল্পনা’ (কি হতে পারে) করে যা ঘটে চলেছে (গুলি, নিপীড়ন,খুন, অপমান, ইজ্জতহানী বাস্তব) সেটাকে জাস্টিফাই করা মতবাদন্ধতা বা দলানদ্ধতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, নৈতিক ও নীতিগত অবস্থান হতে পারে না।
নীতিগত অবস্থান নিতে হলে আমাদেরকে ফ্যাক্টের ভিত্তিতে নিতে হবে (ফ্যাক্ট সর্বদা অতীত বা যা ঘটে গেছে), অনুমান বা কল্পনার ভিত্তিতে নয়। এভাবে ভাবতে পারলেই আমরা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল , প্রিজুডিস এবং চেপেবসা বায়াসকে অতিক্রম করতে শিখব।
গত পঞ্চাশ বছর একটা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চলেছে, যার ফলে আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় এক্সক্লুসিভলি ধর্মীয় রক্ষণশীল কোন গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসেনি। বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক সফলতা হল এখানে ভারতের বিজেপি-আরএসএস মত কোন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আরহন ঘটেনি। সেরকম সাম্প্রদায়িক কোন দলও আমাদের এখানে গড়ে উঠেনি। মৌলবাদী দলের অস্তিত্ব আমাদের এখানে আছে সত্য, এর বিস্তারও ঘটেছে সেকুলার, লিবারেল জাতীয়তাবাদীদের এক্সক্লুসনারী রাজনীতির কারনে, যেখানে রক্ষণশীলদের জন্য কোন স্পেইস রাখা হয়নি।
এই অর্জন থেকে আমাদের পরবর্তী ধাপ হতে হবে একটা মতবাদ-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণ। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের এখানে ধর্মে-ধর্মে, হিন্দু-মুসলিম রায়টের অস্তিত্ব দেখা যায়নি, কিন্তু মতাদর্শিক ভায়োলেন্স হয়েছে প্রচুর, রক্ত ঝরেছে অনেক। এ কারনেই মতবাদ-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আর সেটা ভাবা সম্ভব সেসব এক্টিভিস্টদের পক্ষে যারা মতাদর্শের স্থলে নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে সক্ষম।
লিখিত, ০৯ এপ্রিল ২০২১