একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় কর্মরত এক মানবাধিকার কর্মি কর্তৃক বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ক্রিটিক করায় এক ছাত্রলীগার তাকে প্রশ্ন করতেছে ‘আপনার মত একজন মানবাধিকার কর্মী কিভাবে এরকম বলতে পারেন?’ আরো খেয়াল করলে দেখবেন আ’লীগাররা বামদেরকে প্রায়ই চার্জ করে এই ভাষায়-‘বাম হয়েও আপনারা ‘ওদের’ মত কথা বলেন?’ এখানে ‘ওদের/ওরা’ মানে কারা? আসলে ‘ওদের/ওরা’ কখনই স্থায়ী কেউ না। প্রয়োজন মাফিক ‘ওদের’ পরিবর্তন হয়। এই রেজিমের শুরুতে ‘ওদের’ ছিল জামায়াত-শিবির, এরপর বিএনপি, এখন নুরুল হক নূর বা আলজাজীরা। সরকার যাকেই প্রতিপক্ষ মনে করবে তাকেই ‘ওদের’ স্থলে বসায়ে দিতে পারেন। তো, এই খবরদারির (মোরাল পুলিশিং) ব্যখ্যা কি?
খেয়াল করে দেখেন এই পুলিশিংটা করছে এমন একজন যে কিনা ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী শাসন সমর্থক। সে যে ফ্যাসিস্ট এতে তার ইজ্জ্বতের কিচ্ছু হয় না, তার ‘নীতি-নৈতিকতা’ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না। উলটো দলের স্বার্থে, মতবাদের স্বার্থে বা ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজে অনৈতিক ও ফ্যাসিস্ট হয়ে অন্যকে নৈতিকতার সবক দেয়াই তার রাজনীতি, দলীয় খেদমত। এরকম লোকদের দেখা যায় মানবাধিকার কর্মি, সুশীল সমাজ বা বামপন্থীদের আদর্শ (স্ট্যান্ডার্ড স্ট্যাটাস ক্যু) অবস্থানে থাকতে প্রতিনিয়ত নৈতিক পেট্রোনাইজিং (পিঠচাপড়ানো) করে। বিষয়টা কিন্তু এমন নয় যে তারা তাদেরকে সমীহ করে। বিষয়টা হল-অরাজনৈতিক, নির্দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠন যাতে নৈতিক ও নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে ফ্যাসিস্টদের লেজিটেমিসিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে।
এতে কিন্তু কাজ হয়। আপনি দেখবেন ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুদের জমি ভোগদখলকারী দলের লোকেরা বামপন্থীদেরকে বলতেছে- হায় হায় আপনি কিভাবে ‘ওদের’ মত সাম্প্রদায়িকদের পক্ষে কথা বলেন? এই ব্যাটা বামপন্থী হয়ত নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নৈতিক প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু যেই না সে ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটা শুনে তখনই হয়ত ভড়কে যায়, তার প্যান্ট ভিজে যাওয়ার উপক্রম হয়। কেননা নীতিগতভাবে সে হয়ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। জালেমরা সেটা জানে এবং জানে তাকে কিভাবে নিষ্ক্রিয় করা যায়। আর তাই তাকে নীতির প্রশ্ন তুলে ইতস্তত করে ফেলে। অথচ ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে মজলুমের (যে কেউ হোক না কেন) পক্ষে এবং জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থানের মতই একটা নৈতিক ও নীতিগত প্রশ্ন।
আমাদের নীতি তো খন্ডিত হতে পারে না, পারে কি? সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপনি নৈতিক অবস্থান নিবেন কিন্তু জুলুমের প্রশ্নে অনৈতিক বা নীতি বিরোধী অবস্থান নিতে পারবেন? কেবল মতাদর্শিক মতলববাজদেরকেই এরকম খন্ডিত নৈতিকতা চর্চা করতে দেখা যায়।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে সরকার নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি, নৈতিক পুলিশিং ও পেট্রোনাইজিং করে বর্তমান স্বৈরাচারী রেজিমের সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন ধারার নির্দলীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিগুলোকেও চাপের উপরে রাখে। তারা চায় আলেমসমাজ তাদের কাজ করুক কিন্তু জালিম সরকারের জুলুম নিয়ে প্রশ্ন না তুলুক, তারা চায় মানবাধিকার কর্মীরা তাঁদের কাজ পেপার ওয়ার্ক করুক কিন্তু বিরোধী দল ও ভিন্নমতের নাগরিকদের উপর মানবাধিকার লঙ্গন নিয়ে ক্যাম্পেইন না করুক, তারা চায় ছাত্ররা পড়াশুনা করুক কিন্তু সরকারের নিয়োগবানিজ্য নিয়ে প্রশ্ন না তুলুক, তারা চায় বামপন্থীরা শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব ও থিসিস নিয়ে কাল্পনিক বুদ্ধিজীবীতা করুক কিন্তু লুটপাট নিয়ে মুখ না খুলুক।
এভাবে করে যেসব ফ্রন্ট থেকে সরকারের বিরোধিতা হতে পারত, যেসব ফ্রন্ট থেকে সরকারকে চাপে রাখা যেতে তাদেরকেও সরকার নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারছে। কোন কোন সময় নিউট্রাল (নিরব/নিরপেক্ষ) থাকাই জালিমের হাতকে শক্তিশালী করে।
করনীয় কি? যারা এক্টিভ রাজনীতি করছেন তারা সেটা করবেন তাদের দলীয় কৌশলে। এখানে আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু যারা সরাসরি রাজনীতি করেন না তাদেরকে কথা বলতে হবে নীতিগত (Principle) জায়গায় দাঁড়িয়ে। নীতিগতভাবে আমি সকল প্রকার নিপীড়ন, নির্যাতন ও জুলুমের বিরুদ্ধে। নীতিগতভাবে আমি সকল প্রকার ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। নীতিগতভাবে আমি গণতন্ত্রের পক্ষে এবং স্বৈরাচারের বিপক্ষে। আমার এই অবস্থান অরাজনৈতিক নয়। আগামীকাল যদি সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার আসে এবং তারা যদি প্রতিপক্ষের উপরে নিপীড়ন চালায়, স্বৈরাচার কায়েম করে, আমি তাদের বিরুদ্ধেও একই নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে এক্টিভিজম করব। ইনশাআল্লাহ।
০১.০৩.২০২১