ইমাম গাজ্জালি মানবসত্ত্বার চারটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন-সাবিইয়া (উগ্রতা মানে রাগ, বিদ্বেষ, সহিংসতা), বাহিমিয়া (পশুসুলভ মানে লোভ, অতিভোজন, কামুক), শয়তানিয়া (মিথ্যাবাদিতা, প্রতারণা, ঘুষ) এবং রব্বানিয়া (ইলম, বুদ্ধিমত্তা, বোধ) ইত্যাদি। প্রথম তিনটা মানুষের নাফসের সাথে আর শেষটা কালবের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে যে সম্ভাবনাটি জয়লাভ করবে মানুষ সেরকমই হয়ে উঠবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ৪ প্রকার মানবসত্ত্বার মধ্য থেকে থেকে রাব্বানিয়াতে নিজের আত্মাকে (self) উত্তীর্ণ করতে চাই। এক্ষেত্রে আল্লামা ইকবালের ‘খুদি'(self) ধারণা খুবই গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়েছে। ইকবালের খুদি মানে নিজের আত্মার ওপর প্রভাববিস্তার, নিজকে জানা,স্বকীয় বোধ এবং নিজের শক্তি বিষয়ে ওয়াকিফহাল হওয়া। নিজের আসল পরিচয় উপলব্ধি। সে আলোকে আমি চাই আমার ‘নাফসানিয়াতকে’ যেন আমার ‘ক্কালব’ পরাজিত করুক। নাফসানিয়াত আমাকে গ্রাস করুক সেটা আমি চাইনা। আমি আমার খুদিকে সে আলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। এটা করতে গেলেই প্রচলিত সমাজ, বন্ধু-বান্ধব ও সতীর্থদের কাছ থেকে বাধা আসতে পারে। এই বাধা অতিক্রম করা পর্যন্ত আত্মার মুক্তি অসম্ভব বলে মনে করি।

আমার মতে, যতক্ষণ না একজন ব্যক্তি নিজের সাথে মোকাবেলা করতে পারছে, তাকে নিজের বেড়ে ওঠা সমাজ, রাজনীতি, দল ও রাষ্ট্রের কাছে প্রতিনিয়ত সেজদা দিয়ে যেতে হয়। এসব থেকে নিজের আত্মার মুক্তি যার ঘটেনি, সে কিভাবে সমাজের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ঘটাবে? নিজেকে অন্ধকারে রেখে কি অন্যকে আলোকিত করা যায়? বিভিন্ন সময়ে আমি এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়েছি। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই প্রশ্ন বোধকরি আরো অনেকের মধ্যেই আছে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তি ও সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কদর্যতাগুলোকে খুবই বিশ্রিভাবে উন্মোক্ত করে দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিট ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী চিহ্নিত করার যে ১৪টি তরিকা দেখাইছেন, তার আলোকে আমি দেখি বাংলাদেশের প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মির মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিদ্যমান। গত কয়েকবছরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যবেক্ষণ করছি ফ্যাসিবাদী মানসিকতার এক কদর্য রূপ। বিভিন্ন মতবাদ ও দল ভিত্তিক এক্টিভিস্টরা পরিবেশ এতটাই দুষিত (টক্সিক) করেছে যে-আপনি কেন তাদের মত ‘তাদের প্রতিপক্ষ’ কাউরে ঘৃণা করেন না-এটাই হতে পারে আপনার ‘অপরাধ’! ফেইসবুকে কারো পোস্টে লাইক বা শেয়ার দেয়ার ভিত্তিতে ‘বন্ধু-শত্রু’ নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে! অর্থাৎ, আপনি যদি কাউরে অপছন্দ করেন, আর আমি যদি ঐ লোকের কোন পোস্টে লাইক দেই, তাহলে আপনার সাথে দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। এর মানে দাঁড়ায় আপনার নিজস্ব কোন পছন্দ-অপছন্দ বিচার করার এবং সে মোতাবেক কাউকে ভাল/মন্দ লাগার অধিকার নাই। এই ধরনের কুটনামী ঐতিহ্যগতভাবে সতীন-সতীনে ছিল। কিন্তু এটা এখন রোগ আকারে বিস্তার ঘটেছে শিক্ষিত ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এক্টিভিস্টদের মধ্যেও!অবস্থাদৃষ্টে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দলীয় ও মতাদর্শিক আনুগত্য প্রকাশের শর্ত বা মানদণ্ড হল বিপরীত মত ও মতবাদের মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ঘৃণার চাষাবাদ। আমি এই ধরনের দুষিত গ্রুপ ও মতবাদের ভোক্তা হতে অস্বীকার করেছি।
আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছিল যে পলিটিকাল ধারার হাত ধরে তাঁদের ফ্যাসিবাদী প্রবনতা প্রত্যক্ষ করে আমি নিজের সাথে মোকাবেলা করার সীদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। এই মোকাবেলা খুব সহজ কাজ না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গেলে বুঝতাম না জীবন পরিক্রমায় আত্মোন্নয়নের জন্য সহ কমরেডদের (peer) অতিক্রম করে যাওয়ার প্রচেষ্টা সাত সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মত কষ্টকর। যাঁদের সাথে একদা সংগঠন, দল এবং রাজনীতি করেছেন, আপনার নতুন চিন্তায় বা পরিবর্তিত বোঝাপড়ায় ‘তাঁরা কি মনে করবেন’ ‘তাঁরা যদি আমাকে ছেড়ে যায়’ বা ‘আমি যদি সঙ্গীচ্যুত হয়ে যাই’ এসব প্রশ্নের ভয়ে বা চাপে অনেকেই প্রয়োজনীয় কথা বলতে পারেন না- হোক সে কথাটা সত্য বা উপলব্ধির মানদন্ডে উত্তীর্ণ। তখন কেউ কেউ ভিন্ন নামে, নিক নামে আইডি খোলে সত্য কথা বলার ভান করেন। এসব যারা করেন, আমার মতে, তারা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনায় ভোগেন এবং ক্রমাগত নিজ আত্মাকে সমর্পন করেনঃ কমরেডদের কাছে, অনুসারীদের কাছে, দলের কাছে, সমাজের কাছে অথবা আরো না জানা খুঁটির (অথরিটির) কাছে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে এই ধাঁধা অতিক্রম করার তওফিক দিয়েছেন।
একজন ব্যক্তিকে সত্যাশ্রয়ী হতে হলে, একজন জ্ঞানীকে গণমানুষের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা চালাতে হলে, একজন আলেমকে তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে, তাকে পরিবেষ্টন করে রাখা কমরেডদের অতিক্রম করে যেতেই হয়, এই যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন বিকল্প আমার জানা নাই। মানুষের ভয় থেকে নিজ আত্মার মুক্তি যার ঘটে নাই তার পক্ষে বুদ্ধিজীবীতা সম্ভব নয়,নয় মানুষের মুক্তির কাজ করাও। ট্যারি আগ্লেটনের মতে ‘বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি ক্ষমতাবানের কাছে সত্যটা বলে।’ এই বিখ্যাত চিন্তকের ভাবনার সাথে আমাদের ধর্মীয় নির্দেশনার যথেষ্ঠ মিল পাই। হাদীসে বলা আছে-‘সর্বোত্তম জিহাদ ওই ব্যক্তি করে যে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলে।’ নোয়াম চমস্কি অবশ্য বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বকে আরো একটু গভীরে দেখেন। তিনি বলেছেন যে ‘ক্ষমতাবনরা সত্য ইতিমধ্যেই জানে, তারা বরং ব্যস্ত সত্য লুকোনোতে। সুতরাং অত্যাচারিতদের কাছে সত্য তুলে ধরাই বুদ্ধিজীবীদের কাজ।’ বর্তমান বাস্তবতায় চমস্কির ভাষ্যকে আমি আমার জন্য করনীয় মনে করি।
নিজের অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধি থেকে বুঝতে পারি বুদ্ধিবৃত্তি মূলতই একাকীত্বের। কারন, এক বুদ্ধিজীবী কখনোই পরিপূর্ণভাবে অন্যের মত ভাবেন না, অন্যকে অনুসরণ করতে পারে না। দ্বিমত অবশ্যম্ভাবী। এর ফলাফল হল-নিজের সাথে নিজের কথোপকথন, একাকীত্বের সংলাপ, নিজের দুনিয়ায় একাকী বিচরণ। বুদ্ধিজীবীতা এক ধরনের গরিবী কাজকারবারও। ধনী পয়সাওয়ালা কেউ বুদ্ধিজীবীতা করে? করে না। তারা বুদ্ধিজীবীদের পোষে। পোষে কারন বুদ্ধিজীবীরা রুটি-রুজির জন্য পরনির্ভরশীল। চিন্তাভাবনা করার জন্য কে টাকা দিবে আপনাকে? কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন- কে টাকা দেবে? যিনি/যারা দিবেন আপনি তার গোলামী করবেন, নয়ত তার অন্যায় দেখলে নীতির সাথে আপোষ করে চুপচাপ থাকবেন অথবা, হেকমত অবলম্বন করে সামগ্রিক কল্যাণার্থে হক কথাটা বলবেন না। সবক্ষেত্রে অবস্থান প্রায় একইঃ গোলামী। দলীয়/দরবারী বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা তো আরো খারাপ। একেবারে দাসসুলভ। গণবিরোধীও। আত্মার বিক্রি ছাড়া আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তি সম্ভব? Who will pay you to think a crucial question. আলহামদুলিল্লাহ, দেশের বাহিরে থাকায় এসব থেকে আল্লাহ এখন পর্যন্ত মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু, একাকীত্ব ও গরীবি? এগুলো থেকে মুক্তি নেই। তা স্বত্বেও, আমি নিজের কাজ স্থির করে নিয়েছি। একটিভ রাজনীতি করব না-এই আমার নীতিগত সিদ্ধান্ত। আমি বুদ্ধিবৃত্তি করব। বুদ্ধিবৃত্তি করব কারন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনে অবদান রাখার আর বাকীসব কার্যক্রম করতে আমি অক্ষম। মজলুম ও অত্যাচারিতদের কাছে সত্য তুলে ধরাকেই আমি লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছি। এটা করতে যেয়ে আমি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারকারী তত্ত্ব, মতবাদ, ব্যক্তি, গ্রুপ ও দলের পর্যালোচনা-সমালোচনা করব। এসব আমি রপ্ত করেছি গত এক দশকে। নতুন করে কোন দলাবদ্ধতায় জড়াবো না। দলাবদ্ধতার শেকল ভাঙতে প্রচুর মেধা, শ্রম ও সম্পর্ক খরচ করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় আরেকবার যেতে চাই না। নীতিগতভাবে আমি মনে করি, কালচারাল এক্টিভিস্টদের একটিভ রাজনীতিতে না জড়ানোই জাতীয় স্বার্থের জন্য উত্তম।