আওয়ামীলীগের সেকুলারিটি ও ধর্মভাব

আওয়ামীলীগ নিজেকে সেকুলারিস্ট দল দাবী করে। তাঁদের কাছে সেকুলারিজম অর্থ হল ‘সর্বধর্মীয় সহাবস্থান’। আ’লীগের এই অবস্থান কনসিসটেন্ট। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে বর্তমান পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো আওয়ামী লীগ দিয়েছে, সবগুলোতে তারা বলেছে ‘কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করা হবে না’। এটাই দলটির অফিসিয়াল অবস্থান। এই দলের হাজির করা সেকুলারিজম ন্যারেটিভে এক ধরনের ধর্মাচ্ছন্নতা রয়েছে। দলটির বড় অংশ সমর্থক ডানপন্থী। এ কারনে সংসদে দাঁড়িয়ে দলটির প্রধান ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং ডেপুটি স্পিকার মোনাজাত করে নির্ধিদায়। এতে দলটির সেকুলারিটি একটুও প্রশ্নের সম্মুক্ষীন হয় না। সমস্যা তাহলে কোথায়? আমার মতে সমস্যার দুটি দিকঃ একটি কিছুটা তাত্ত্বিক, আরেকটি প্রায়োগিক।

তাত্ত্বিকভাবে, আমাদের জমিনে সেকুলারিজমের তত্ত্ব ও চর্চায় বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ইসলামপন্থীদের কাছে সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। মজার ব্যাপার হল, একই অর্থ বামপন্থীরাও গ্রহণ করে, তবে সম্পূর্ন ভিন্ন কারনে। ইসলামপন্থীরা সেকুলারিজমকে বর্জন করার লক্ষ্যে ‘ধর্মহীনতা’ হিসেবে ক্যাম্পেইন করে, আর বামপন্থীরা রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ঠেকাতে সেকুলারিজম কায়েম করতে একই অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে সেকুলারিজম হল ‘সর্বধর্মীয় সহাবস্থান’, যা স্বাধীনতার পর থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে পাশ্চাত্য ভার্সনের সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠায় যারা আগ্রহী এবং যারা এর বিরোধী, উভয়ের কাছেই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় চর্চিত সেকুলারিজমকে উদাহরণ হিসেবে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক অনিহা লক্ষ্যণীয়। এর অন্যতম কারণ দুই গ্রুপেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী নিজস্ব মতবাদের রাজনীতি। তাঁদের স্ব স্ব রাজনীতির প্রয়োজনেই অভিধানে সংজ্ঞায়িত সেকুলারিজম ও তাঁর ব্যাখ্যাকে সামনে আনতে দেখা যায়। তাত্ত্বিক এই অবস্থার পাশাপাশি বাস্তবিক কিছু কারনও আছে।

বাস্তবতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যারা করে তারা বাঙালী মুসলমানের যে গড় চরিত্র, সেটাই হাজির করেছে রাজনীতিতে। চরিত্র ও মননে মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী, রাজনীতি ও ক্ষমতা চর্চায় সুলতানী এবং ধর্ম প্রশ্নে আবেগপ্রবণ, এসবের স্বমন্বয়ে গঠিত দ্বৈততাপূর্ণ আমাদের জাতীয় চরিত্র। এই ধরনের চরিত্রই আ’লীগ রিপ্রেজেন্ট করে। শাসকগোষ্ঠীর অংশীদার অন্যান্য দলগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। ফলে, তাঁদের পক্ষে পাশ্চাত্যের সেকুলারিজম কোন দিনই এখানে কায়েম করা সম্ভব নয়, দরকারও নেই। তবে, আ’লীগকে রক্ষণশীলদের সন্দেহ করার বাস্তবিক আরেকটা কারন হচ্ছেঃ আ’লীগে বামপন্থী ও সাবেক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসিদের অনুপ্রবেশ। পাকিস্তান আমল থেকেই এই অনুপ্রবেশের কারনে দলের পাবলিক চরিত্র নিয়ে রক্ষণশীলদের মধ্যে মাঝে মাঝে সংশয় তৈরি হয়। আ’লীগকে বিভিন্ন সময় এই সংশয় দূর করতে বিভিন্ন কৌশল নিতে দেখা গেছে। এখন সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে ধর্মপন্থীদের সাথে ‘লাভ-হেইট’ খেলে এবং বৈধতা অর্জন করতে চাচ্ছে মসজিদ প্রজেক্টের মাধ্যমে। এতে কি কাজ হবে? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে, গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে যে পর্যায়ে রাষ্ট্রকে এনেছে, সেটা থেকে উত্তরণ এত সহজে হবে বলে আমার মনে হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *